ফাইতং ইউনিয়ন কোনো ক্ষুদ্র জনপদ নয়। প্রায় ১৬,০০০ একর, অর্থাৎ ৬৪.৭৫ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত এই ইউনিয়ন একটি বৃহৎ পাহাড়ি অঞ্চল। ২০১১ সালে প্রশাসনিক সেবা সহজ করার লক্ষ্যে তৎকালীন ৪নং আজিজনগর ইউনিয়নকে বিভক্ত করে ৭নং ফাইতং ইউনিয়ন গঠন করা হয়। স্থানীয় মানুষের প্রত্যাশা ছিল—নতুন ইউনিয়নের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা কাছে আসবে, উন্নয়নের আলো পৌঁছাবে ঘরে ঘরে।
কিন্তু এক দশকেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও ফাইতং ইউনিয়ন আজও পড়ে আছে উন্নয়নের প্রান্তসীমায়। চারদিকে দুর্গম পাহাড়, ভাঙাচোরা সড়ক আর দারিদ্র্যের চাপে নুয়ে পড়া জীবন—এই বাস্তবতার মধ্যেই এখানকার মানুষ প্রতিদিন বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এখানে “নুন আনতে পান্তা ফুরায়” কোনো প্রবাদ নয়; এটি প্রতিটি পরিবারের নিত্যদিনের বাস্তবতা, প্রতিটি রাতের নীরব কান্না।
প্রথমত: ৬৪.৭৫ বর্গ কিলোমিটারে নেই একটি হাসপাতাল
এত বিশাল একটি ইউনিয়নে নেই একটি ন্যূনতম হাসপাতালও—এটি শুধু অবহেলা নয়, এটি চরম মানবিক ব্যর্থতা। গভীর রাতে প্রসববেদনায় কাতর মা, পাহাড়ি পথে দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিক কিংবা জ্বরে কাঁপতে থাকা শিশুকে কোলে নিয়ে পরিবারকে ছুটতে হয় লামা বা চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। দুর্গম রাস্তা, যানবাহনের সংকট আর সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলা এই যাত্রা অনেক সময় মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
ফাইতংবাসীর দাবি একটি দশ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল। এটি কোনো বিলাসিতা নয়—এটি মানুষের বাঁচার শেষ আশ্রয়।
দ্বিতীয়ত: নিরাপত্তাহীন জনপদ, বিচার পেতে হিমশিম
বিস্তীর্ণ আয়তনের ফাইতং ইউনিয়নের তুলনায় এখানকার আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল। একটি পুলিশ ফাঁড়ি থাকলেও তার সক্ষমতা সীমিত, জনবল ও লজিস্টিক সহায়তা অপ্রতুল। ফলে একটি সাধারণ অভিযোগ কিংবা মামলা করতে হলে সাধারণ মানুষকে সুদূর লামা উপজেলা সদরে যাতায়াত করতে হয়, যা পাহাড়ি ও দুর্গম পথ হওয়ায় সময়সাপেক্ষ, ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ।
এই যাতায়াত পথেই প্রায়শই চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মতো অপরাধের ঘটনা ঘটে। ন্যায়বিচার পেতে গিয়ে মানুষকে নিজের নিরাপত্তাই ঝুঁকির মুখে ফেলতে হয়—এ এক নির্মম বাস্তবতা। অনেক ক্ষেত্রেই এই ভোগান্তির ভয়ে মানুষ মামলা করতেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, ফলে অপরাধীরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে।
এদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ফাইতং পুলিশ ফাঁড়ির নিজস্ব পরিবহন সুবিধার অভাব পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। জরুরি ঘটনায় দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছানো, নিয়মিত টহল দেওয়া কিংবা পাহাড়ি এলাকায় নজরদারি—সবই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পরিবহন সংকটের কারণে। ফলে বিশাল এই ইউনিয়নে কার্যকর আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
তৃতীয়ত: দারিদ্র্যের চাপে ঝরে পড়ছে শিক্ষার আলো
পাহাড়ঘেরা ফাইতং ইউনিয়নে শিক্ষাই হতে পারত দারিদ্র্য থেকে মুক্তির প্রধান হাতিয়ার। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। এই ইউনিয়নে কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষার কোনো কার্যকর সুযোগ নেই। ফলে দারিদ্র্যের তাড়নায় বহু কিশোর–তরুণ অল্প বয়সেই বই-খাতা ফেলে জীবিকার সন্ধানে নামতে বাধ্য হয়। তাদের স্বপ্নগুলো পাহাড়ের ঢালে নীরবে ঝরে পড়ে—কেউ শ্রমিকে পরিণত হয়, কেউ ইটভাটায়, কেউ অনিরাপদ কাজে জড়িয়ে পড়ে।
ফাইতং ইউনিয়নে একটি মাত্র উচ্চ বিদ্যালয় থাকলেও সেটিও নানা সংকটে জর্জরিত। বিদ্যালয়ে মানসম্মত বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের ঘাটতি প্রকট। প্রয়োজনীয় শ্রেণিকক্ষের অভাবে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ব্যাহত হয়। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো—এই বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান শাখা নেই। বর্তমানে কেবল মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ চালু থাকলেও সেগুলোও পর্যাপ্ত শিক্ষক, উপকরণ ও পরিকল্পনার অভাবে খুড়িয়ে চলছে।
এর ফলে মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানভিত্তিক উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখার আগেই ঝরে পড়ে। পাহাড়ি এই জনপদের সন্তানদের সামনে শিক্ষা যেন সম্ভাবনার দুয়ার নয়, বরং সীমাবদ্ধতার দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই অবস্থায় ফাইতং ইউনিয়নে একটি স্বতন্ত্র কারিগরি স্কুল প্রতিষ্ঠা, অথবা অন্তত ফাইতং উচ্চ বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান ও কারিগরি শাখা চালু করে প্রয়োজনীয় শিক্ষক ও শ্রেণিকক্ষ নিশ্চিত করা এখন সময়ের অপরিহার্য দাবি।
কারণ শিক্ষা ছাড়া উন্নয়ন কেবল কাগজে থাকে, আর শিক্ষার সুযোগ না থাকলে একটি প্রজন্ম অন্ধকারেই হারিয়ে যায়।
চতুর্থত: ইটভাটা ও ভাঙা সড়ক—নিত্যদিনের দুর্ভোগ
ফাইতং ইউনিয়নে প্রায় ৩০টি ইটভাটা ভারী যানবাহন চালিয়ে গ্রামীণ সড়কগুলোকে মৃত্যুফাঁদে পরিণত করেছে। স্কুলগামী শিশুরা হোঁচট খায়, রোগীবাহী গাড়ি মাঝপথে আটকে পড়ে, সাধারণ মানুষের যাতায়াত হয়ে ওঠে যন্ত্রণাদায়ক ও ঝুঁকিপূর্ণ।
ইটভাটার যানবাহনের জন্য বিকল্প সড়ক ব্যবস্থা এখন আর বিলম্ব সহ্য করে না।
পঞ্চমত: মাঠহীন তরুণ সমাজ, অন্ধকার ভবিষ্যৎ
৬৪.৭৫ বর্গ কিলোমিটারের এই ইউনিয়নে তরুণদের জন্য নেই একটি খেলাধুলার মাঠও। মাঠ মানে শুধু খেলার জায়গা নয়—এটি শৃঙ্খলা, সুস্থ মানসিকতা ও স্বপ্ন গড়ার জায়গা। মাঠের অভাবে তরুণেরা শারীরিক ও মানসিক বিকাশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অনেকেই ভুল পথে পা বাড়াচ্ছে।
একটি খেলার মাঠ আজ ফাইতংয়ের ভবিষ্যৎ রক্ষার প্রশ্ন।
ষষ্ঠত: পরিবেশ ও কৃষির ওপর নীরব ধ্বংসযজ্ঞ
ইটভাটার অনিয়ন্ত্রিত বিস্তার কৃষি, বন ও জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। ফসলি জমি নষ্ট হচ্ছে, পাহাড় ও বন উজাড় হচ্ছে, পরিবেশ ভারসাম্য হারাচ্ছে।
কৃষি ও পরিবেশ সুরক্ষায় যুগোপযোগী প্রকল্প, পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব ইটভাটায় রূপান্তরের জন্য সরকারি প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনা এখন সময়ের দাবি।
সপ্তমত: মৃত খাল, শুকিয়ে যাওয়া জীবনের ধারা
ফাইতং ইউনিয়নের প্রাণ ছিল তার খালগুলো—ফাইতং খাল, কারিয়ান খালসহ আরও কয়েকটি ছোট খাল। একসময় এখানকার মানুষ এই খালে গোসল করত, কাপড়-থালাবাসন ধুত, এমনকি এখান থেকেই মাছ আহরণ করে আমিষের চাহিদা মেটাত। এই খালগুলোই ছিল দরিদ্র মানুষের জীবনের নীরব ভরসা।
আজ সেই খালগুলো মৃত। পানির কোনো চিহ্ন নেই, জীবনের কোনো স্পন্দন নেই। ইটভাটার জন্য খালে বাঁধ দিয়ে পানি আটকে নেওয়ার ফলে প্রতিটি খাল ধীরে ধীরে শুকিয়ে গেছে। খাল মরে যাওয়ায় শুধু পানি হারায়নি ফাইতং—হারিয়েছে মাছ, কৃষি, পরিবেশ ও মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন।
এই খালগুলো দখলমুক্ত করে স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনা এখন শুধু পরিবেশগত নয়, মানবিক জরুরি দাবি। কারণ খাল মরে গেলে শুধু পানি মরে না—মরে যায় একটি জনপদের আত্মা।
২০১১ সালে ফাইতং ইউনিয়ন গঠনের উদ্দেশ্য ছিল মানুষের জীবন সহজ করা। কিন্তু আজও এই ইউনিয়নের মানুষ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। তারা দয়া চায় না—
তারা চায় বাঁচার অধিকার।
তারা চায় এমন একটি ফাইতং, যেখানে অসুখে মানুষ মরবে না, তরুণেরা পথ হারাবে না, খালগুলো আবার প্রাণ ফিরে পাবে, আর পাহাড়ের বুকেও মানবিক উন্নয়নের আলো জ্বলবে।
এখন প্রশ্ন একটাই—রাষ্ট্র কি এই ৬৪.৭৫ বর্গ কিলোমিটারের মানুষের কান্না শুনবে, নাকি ফাইতং অবহেলার পাহাড়েই চাপা পড়ে থাকবে?

এবিএন ডেস্ক 





















