উত্তরবঙ্গের নরম মাটির দেশ লালমনিরহাট। এই মাটিতে শীতের সকালে যেমন কুয়াশা নামে, তেমনি নামে মানুষের গল্প—ভালবাসা, বেদনা, আর সুরের জন্মকথা। সেই গল্প থেকেই উঠে আসে এক নাম—কামরুল ইসলাম কনা। এক তরুণ, যার কণ্ঠে রয়েছে নদীর ভাষা, বাতাসের নিশ্বাস, আর বাংলার বাউল-সুফি সুরের গভীরতম তান।
কালীগঞ্জ উপজেলার চলবলা ইউনিয়নের শিয়ালখোওয়া হাট। চারদিকে সরিষার হলুদ রঙ, খড়ের গন্ধ আর দূরের বাঁশবাগানের ফাঁক দিয়ে ভেসে আসা পাখির ডাক। সেই গ্রামে বীরমুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. শামসুল হক ও মা মোছাঃ তারা বানু বেগমের তৃতীয় সন্তান কামরুল ইসলাম কনা।
ছোট্ট কনা তখনই বুঝে গিয়েছিল তার খেলার সাথী অন্যরা নয়,তার একমাত্র প্রিয় হলো সুর। প্রাইমারি স্কুলে বৃহস্পতিবার এলেই শিক্ষকরা অপেক্ষা করতেন আর আগ্রহ করে বলতেন “আজ কনা গান গাইবে”।
আর সে গাইত—মাটির গন্ধ মাখা বাউলের গান, ভোরের শিশিরের মতো কোমল, আবার কখনো গভীর অরণ্যের মতো নীরব।
কনার শিক্ষার দীর্ঘ পথ কিন্তু সুরই ছিল একমাত্র বিরামহীন সাথী। শিয়াল খোওয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু হওয়া শিক্ষাযাত্রা তাকে নিয়ে যায় শিয়াল খোওয়া এস.সি উচ্চ বিদ্যালয়, তারপর আদিতমারী ডিগ্রি কলেজে। মেধা ও পরিশ্রমের জাদুতেই “উত্তর বাংলা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ” থেকে ইতিহাসে অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস, এরপর ইতিহাসেই রংপুরের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কারমাইকেল কলেজ থেকে মাস্টার্সেও ফার্স্ট ক্লাস।
সবাই ভেবেছিল এত পড়াশোনা শেষে নিশ্চয়ই বড় কোনো চাকরি করবে। কিন্তু চাকরির অফারও কম আসেনি। কিন্তু কনার মন ছিল অন্য কোথাও, তার মন বাঁধা ছিল তানপুরার তারে, আর বাউল সুরের গোপন দরজায়।
হঠাৎ ঝড়ে ভেঙে পড়া শৈশব, আর নতুন করে উঠে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প।
বাল্যকালেই মাকে হারান কনা। সেই শোক, সেই শূন্যতা তাকে আরও নীরব করে দেয়। কিন্তু তার জীবন যেন সবসময়ই মানুষের স্নেহে আলোকিত ছিল। বাবা, বড়ভাই তাইজুল ইসলাম মুকুল, মোনারুল ইসলাম মনা এবং ভাবি সীমা খাতুন এই চারজনের ভালোবাসায়ই বড় হন তিনি।এরপর শুরু হয় প্রকৃত সংগীতযাত্রা।
হাতিবান্ধার সাধু মঞ্জিলের স্নেহময়ী পৃষ্ঠপোষক মোছাঃ বুলবুলি বেগম যিনি তাকে সুরের দিকনির্দেশনা ও সুফি সংগীত তত্বভেদ শিক্ষা দিয়েছেন। তার হাত ধরেই কনা শিখতে থাকেন বাউল, ফকিরী, সুফি, মারফতি গানের আসল রস। গুরুর আশীর্বাদ আর গানকে জীবনের অন্যতম তীর্থভূমি মনে করা।
বাংলাদেশের কিংবদন্তি সাধক ভিক্ষুসাধু ফকির তার গানে কনার প্রাণ জেগে উঠত। তার সুর যেন আগুনের মতো, আবার কখনো নদীর মতো শান্ত। পরবর্তীতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণী সংগীতশিল্পী ওয়াজকুরুনী ফকির সাহেব তার কাছ থেকেও কনা নিয়মিত তালিম নেন।
এই দুইজনের আশীর্বাদই কনাকে তৈরি করে একটি পূর্ণাঙ্গ লোকসংগীতশিল্পীতে। তার গানে কখনো মাঠের মেঠো গন্ধ, কখনো দুঃখিনী নদীর সুর, কখনো আবার মানুষের বেদনার হাহাকার।
বাংলার মাটিতে কনার কণ্ঠ মানুষের ভিড়, শিহরণ, অভিভূত শ্রোতা। কনা যেখানেই গান করেন লোকেরা থমকে দাঁড়ায়। কারণ তার কণ্ঠে শুধু গান নয়, আছে গল্প, আছে ব্যথা, আছে সত্য, আছে প্রার্থনা।
তরুণ উদীয়মান এ শিল্পী যেসব গান করেন তার মধ্যে
লালন,সুফি কবিগান, মারফতি সুর, ফকিরী গান, বাউলের দেহতত্ত্ব ও ফেরাফেরা।
এ যেন শুধু সংগীত নয় এটি একটি যাত্রা, মানুষের অন্তরের পথে হাঁটার গল্প। মানুষের পাশে দাঁড়ানো এক নীরব অভিপ্রায়। “মানবতার কিরণ” নামের আশ্রয়।
শুধু গানেই নয়, কনা মানুষের পাশেও দাঁড়িয়েছেন।
তার ছোট্ট সংগঠন “মানবতার কিরণ”এখন বহু অসহায় মানুষের সহায়। এ যেন তার মায়ের স্মৃতির জন্য একটি নীরব দান, তার হৃদয়ের আরেকটি গান।
কনার সামনে আসছে এক নতুন পৃথিবী, ভারতে অডিশন, উচ্চশিক্ষা, আরও বড় মঞ্চের সাক্ষী হতে যাচ্ছে সে।
নতুন বছরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে কনা জানালেন,
“ভারতে বড় বড় অডিশন আছে সামনে, আর সংগীতে উচ্চশিক্ষার প্রস্তুতিও চলছে।”
বর্তমানে দেশের বিভিন্ন জেলা সফর করে, মঞ্চে মঞ্চে বাউল, সুফি সুরে শ্রোতাদের মোহিত করছেন এই তরুণ।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, তিনি ইউটিউব বা ফেসবুক পেজ কিছুই ব্যবহার করেন না। শুধু ব্যক্তিগত প্রোফাইল Kamrul Islam Kona—এইটুকুই তার সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যাম।
অবশ্যই প্রিয়, তোমার দেওয়া পুরো প্রতিবেদনের আবহ, সাহিত্যরস, আবেগ আর গ্রামের বাস্তবতা ধরে একটি শক্তিশালী “এলাকাবাসীর বক্তব্য” সাজিয়ে দিচ্ছি—
কনার প্রতিবেশীরা বলেন “কনা আমাদের গ্রামের আশীর্বাদ। ছোটবেলা থেকেই দেখি, অন্য ছেলেরা খেলাধুলা করলেও কনা এক কোণে চুপচাপ বসে সুর করে। মা হারানোর পরও ছেলেটা কোনোদিন পথভ্রষ্ট হয়নি। গানই ছিল তার ভরসা, তার সাহস। এখন যখন সে মঞ্চে দাঁড়িয়ে গান করে, মনে হয় আমাদের গ্রামেরই কোনো পাখি ডানা মেলে আকাশে উড়ছে। এমন চরিত্র, এমন ভদ্রতা, এমন সাধনা আজকাল খুব কম তরুণের মধ্যে দেখা যায়। আমরা সবাই বিশ্বাস করি, একদিন সে গুণী শিল্পী হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলবে এবং দেশের গর্ব হবে।”
শূন্য থেকে উঠে আসা এই যুবক আজ একটি প্রজন্মের অনুপ্রেরণা। তার কণ্ঠে জীবনের গল্প, তার সুরে মাটির ঘ্রাণ, তার চোখে স্বপ্নের আলো। যে নাম একদিন বাউল, সুফি সংগীতের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় লিখবে।
একদিন হয়তো বিদেশের মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি বলবেন,
“আমি লালমনিরহাটের শিয়ালখোওয়া হাটের ছেলে, বাংলার মাটিই আমার সুর।”

বিনোদন ডেস্ক 
























