বিস্তীর্ণ পাহাড়, আঁকাবাঁকা ঝর্ণা, ছায়াঘেরা বনভূমি আর স্বপ্নিল ভোরের মেঘ—এই সবকিছু মিলিয়ে বান্দরবানের লামা উপজেলা আজ বাংলাদেশের পর্যটন মানচিত্রে এক উজ্জ্বল উদীয়মান জনপদ। প্রকৃতির প্রশান্তি, পাহাড়ি মানুষের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি এবং শান্ত পরিবেশ পর্যটকদের এমনভাবে আকর্ষণ করছে, যেন এই পুরো অঞ্চল প্রকৃতির হাতে গড়া এক স্বর্গভূমি।
লামার পর্যটনচিত্রে সবচেয়ে উজ্জ্বল নাম নিঃসন্দেহে মিরিঞ্জা ভ্যালি। টানা পাহাড়শ্রেণির ওপর দাঁড়িয়ে দূরের নীলাভ পাহাড় মেঘে ঢেকে থাকা দৃশ্য যে কাউকে আবিষ্ট করে। ভোরের প্রথম আলোয় মিরিঞ্জার দৃশ্য আরো মোহনীয়—মেঘের দল পাহাড়ের বুক ঘেঁষে নরম আস্তরণের মতো নেমে আসে।
পাখির কিচিরমিচির, অরণ্যের স্নিগ্ধ নিস্তব্ধতা আর বাতাসের স্বাভাবিক শীতলতা পর্যটকদের মনে অসাধারণ প্রশান্তি এনে দেয়। দেশের নানা প্রান্ত থেকে প্রতিদিনই ভ্রমণপিপাসুরা এখানকার প্রশান্ত পরিবেশ উপভোগ করতে ছুটে আসছেন।
লামা উপজেলার ভৌগোলিক বৈচিত্র্যই এ অঞ্চলের প্রধান সম্পদ। পাহাড়ি ঢেউয়ের মতো ওঠানামা করা ভূমি, নদীর স্রোতের মৃদু শব্দ এবং চারপাশ ঘিরে থাকা সবুজের অফুরন্ত বিস্তার প্রকৃতিকে এখানে করে তুলেছে আরও জীবন্ত।
বছরের বিভিন্ন ঋতুতে লামার দৃশ্যপট বদলে যায়—বর্ষায় ঝর্ণার গর্জন, শীতে পরিষ্কার আকাশ আর নীল রঙের গভীরতা, আর গ্রীষ্মে সবুজের উজ্জ্বলতা লামাকে প্রতিবারই নতুনভাবে সাজিয়ে তুলে।
লামা শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্যেই নয়, মানুষের সংস্কৃতিতেও সমৃদ্ধ। এখানে বসবাসরত বিভিন্ন পাহাড়ি আদিবাসী জনগোষ্ঠী—মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, চাকমা ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রা পর্যটকদের আকৃষ্ট করে।
তাদের ঐতিহ্যবাহী নৃত্য, গান, হস্তশিল্প, পোশাক, উৎসব ও খাবার লামাকে এক অনন্য সাংস্কৃতিক কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে। ভ্রমণকারীরা এখানে এসে স্থানীয়দের আতিথেয়তা, শান্ত স্বভাব এবং স্বতন্ত্র জীবনধারা দেখে মুগ্ধ হন।
প্রকৃতি যেমন চোখে দেখা, সংস্কৃতি তেমন হৃদয়ে অনুভব করার মতো এক অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে।
পর্যটকের আগমন লামার অর্থনীতিকে দ্রুত বদলে দিচ্ছে। মিরিঞ্জা ও আশপাশের এলাকায় নতুন রিসোর্ট, কটেজ, হোমস্টে, রেস্তোরাঁ, পরিবহনসেবা এবং স্থানীয় হস্তশিল্পের দোকান গড়ে উঠছে।
স্থানীয়দের নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে, কৃষিপণ্য ও হস্তশিল্প বিক্রি বেড়েছে, তরুণদের উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিকল্পিত বিনিয়োগ ও টেকসই পর্যটন ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে লামা দেশের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটনক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে।
পর্যটন সুবিধা দ্রুত বাড়লেও অবকাঠামোগত কিছু সীমাবদ্ধতা এখনও রয়ে গেছে। উন্নত সড়কপথ, নিরাপদ ভিউপয়েন্ট, পর্যটন নির্দেশিকা, সাম্প্রতিক তথ্যকেন্দ্র, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্যসেবা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন জরুরি।
স্থানীয় প্রশাসন পর্যটনবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে কিছু উদ্যোগ নিলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিয়মিত তদারকি, প্রশিক্ষিত কর্মী এবং আধুনিক ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন প্রয়োজন।
লামা ভ্রমণ মানে কেবল পাহাড় দেখা নয়—এখানে প্রকৃতি পর্যটককে স্পর্শ করে। মেঘ ছোঁয়া পাহাড়, বাতাসের সুর, নদীর গর্জন আর বনভূমির নিরবতা মানুষকে ভেতর থেকে শান্ত করে তোলে।
অনেকের জন্য এটি এক ধরণের মানসিক পুনর্জাগরণ; শহরের কোলাহল থেকে দূরে এসে এখানে মানুষ আবারও প্রকৃতিকে নতুনভাবে আবিষ্কার করে।
মিরিঞ্জা ভ্যালিতে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত তাই পর্যটকদের স্মৃতিতে অমলিন হয়ে থাকে।
লামা উপজেলা প্রকৃতি, সংস্কৃতি এবং মানুষের মিলনস্থল—যেখানে মিরিঞ্জার পাহাড় ও মেঘ কেবল দৃশ্য নয়, অনুভূতি। স্থানীয় সংস্কৃতির বৈচিত্র্য ও মানুষের আন্তরিকতা পর্যটনের প্রাণ।
যথাযথ পরিকল্পনা, নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা গেলে খুব অল্প সময়েই লামা বাংলাদেশের প্রধান পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হবে—এক এমন স্থান, যেখানে প্রকৃতি ও মানুষ মিলেমিশে গড়ে তোলে এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা।

ফরহাদ আহমদ সজল, বান্দরবান 





















