বাংলাদেশ–মিয়ানমার সীমান্তবর্তী বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি অঞ্চল সাম্প্রতিক মাসগুলোতে নতুন করে আলোচনায় উঠে এসেছে মাদক পাচার ও আন্তঃসীমান্ত সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রভাব বিস্তার নিয়ে। স্থানীয় তঞ্চঙ্গ্যা ও মারমা সম্প্রদায়ের কয়েকজন সদস্য আরাকান আর্মির সহযোগী হয়ে মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত—এমন অভিযোগ ও তথ্য উঠে এসেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদে। একইসঙ্গে নিখোঁজ দুই ব্যক্তির ঘটনাকে মাদকচক্রের অংশ হিসেবে অপহরণ নাটক সাজানোর অভিযোগও মিলেছে, যা পাহাড়ি সমাজে তীব্র আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
২৩ সেপ্টেম্বর রেজু মৌজার ভালুকিয়ার খালসংলগ্ন খামার বাড়ি থেকে ৩০টি গরুসহ ওয়ামং তঞ্চঙ্গ্যার নিখোঁজ হওয়া এবং ৮ অক্টোবর একই খালের ওপরে জুমে কাজ করতে গিয়ে জ্যোতিরাম তঞ্চঙ্গ্যার নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা এলাকায় উদ্বেগ সৃষ্টি করে। পাহাড়ি সংগঠনগুলো মানববন্ধন করে প্রশাসনের ব্যর্থতাকে দায়ী করলেও কর্তৃপক্ষের দাবি—উভয় ব্যক্তি আত্মগোপনে গিয়ে মাদক পাচারচক্রের সঙ্গে যুক্ত থাকার পর অপহরণের নাটক করেন। প্রশাসনের এই বক্তব্য পাহাড়ি সমাজের একাংশে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে—নিখোঁজের আড়ালে কি সত্যিই আরও বড় কোনো অপরাধচক্র কাজ করছে?
এরই মধ্যে পরিস্থিতি নতুন মোড় নেয় ১৭ নভেম্বর ভোরে সোনাইছড়ি ইউনিয়নের হাতিমারাপাড়া পাহাড় এলাকা থেকে মিয়ানমার নাগরিক সুমিঅং তঞ্চঙ্গ্যাকে আটক করার ঘটনায়। পুলিশ জানায়, তিনি অবৈধভাবে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে স্থানীয় সহযোগীদের সহায়তায় দীর্ঘদিন ধরে আরাকান আর্মির হয়ে মাদক পাচারের কাজ করছিলেন। জিজ্ঞাসাবাদে উঠে আসে দুই সহযোগীর নাম—ঘুমধুমের মংজয় পাড়ার মংগ্যা তঞ্চঙ্গ্যা এবং সোনাইছড়ির লাইক্য মং তঞ্চঙ্গ্যা। সুমিঅং স্বীকার করেন, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশ সীমান্তে প্রায় ২৫০–৩০০ কার্ট ইয়াবা পাচারের সঙ্গে তিনি সরাসরি জড়িত ছিলেন।
এছাড়া আরাকান আর্মি নিয়মিতভাবে স্থানীয় তঞ্চঙ্গ্যা ও মারমা যুবকদের মাদক বহন, পাহারা এবং সীমান্ত গাইডের মতো কাজে যুক্ত হতে প্রলুব্ধ করছে বলেও জানান তিনি। তার দাবি, তার কাছে ১০ কার্ড ইয়াবা এবং আরাকান আর্মির সরবরাহকৃত একটি আগ্নেয়াস্ত্র ছিল; যদিও পুলিশের অভিযানে সেগুলো উদ্ধার সম্ভব হয়নি। পুলিশ বলছে, তার সহযোগীরা আগাম খবর পেয়ে মাদক ও অস্ত্র সরিয়ে ফেলেছে।
ঘটনা দুটি মিলে সীমান্তবর্তী জনপদে প্রশ্ন উঠেছে—আরাকান আর্মি কি বাংলাদেশে নতুন ধরনের নেটওয়ার্ক তৈরি করছে? স্থানীয়দের অভিযোগ, সম্প্রতি কিছু ব্যক্তি যুবকদের মিয়ানমার বা আরাকান আর্মির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার প্রলোভন দেখাচ্ছে, যা পাহাড়ি সমাজে অস্থিরতা বাড়াচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, সীমান্তে নজরদারি আরও জোরদার করা হয়েছে এবং আন্তঃসীমান্ত মাদকচক্রের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা প্রশাসন জানিয়েছে, মিয়ানমারের কোনো নাগরিককে অনুপ্রবেশ করতে দেওয়া হবে না এবং বিজিবি সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। তবে সীমান্তের জটিল ভূপ্রকৃতি, স্থানীয় দালালচক্র ও আরাকান আর্মির ক্রমবর্ধমান প্রভাব এই অঞ্চলের নিরাপত্তাকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলছে।
সব মিলিয়ে, বান্দরবানের সীমান্তে মাদক ও সশস্ত্র নেটওয়ার্কের বিস্তার এখন শুধু আইনশৃঙ্খলা সমস্যাই নয়—এটি এক সামাজিক সংকটের রূপ নিতে শুরু করেছে। স্থানীয় জনগোষ্ঠী, প্রশাসন ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সংস্থার সম্মিলিত প্রতিরোধ ছাড়া এ সমস্যা দীর্ঘমেয়াদে আরও ভয়াবহ আকার নিতে পারে—এমন আশঙ্কাই এখন সর্বত্র ঘুরপাক খাচ্ছে।

ফরহাদ আহমদ সজল, বান্দরবান 





















